আবুল বাশার
জ্যোতি বসু ছিলেন জননায়ক। শুধু একটি বামপন্থী দলের নেতা ছিলেন না। পার্টির সীমানা তিনি অতিক্রম করে গিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা জ্যোতি বসুই পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সংস্কার আন্দোলনের কাণ্ডারী। তাঁরই নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল শ্রমিক আন্দোলনের সংহত শক্তি। ৬০ দশকের একেবারে গোড়ায় যে খাদ্য আন্দোলন বামপন্থী শক্তির উত্থান ঘটায় তারই সুফল পেয়েছেন এ দেশের নানা ধরনের বামপন্থি দলগুলো। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বেই দানা বেঁধেছিল বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির দীর্ঘস্থায়ী ঐক্য। উগ্র বামপন্থী দলগুলো যখন নিজেদের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে নানা ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে চলছে, তখন জ্যোতি বসু বাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
সহজ কথায় বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ বছরের বামপন্থী সরকার টিঁকে রইল তাঁর জীবনীশক্তিতে। তিনিই সারা ভারতে যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, যা সবচেয়ে সফল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গের যে ভূমিব্যবস্থা, টুকরো টুকরোভাবে বিভিন্ন মালিকানায় বিভক্ত যে জমি, তাতে ভূমি সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলাই কঠিন, এক্ষেত্রেও জ্যোতি বসু সফল। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠায় আইনের পথে ভূমিসংস্কার করেন এবং বাইরে থেকে গড়ে তোলেন কৃষক আন্দোলন। এই কৃষক আন্দোলনের জেরে বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি সব পর্যায়ে এই জননেতার অবদান অনস্বীকার্য।
গরিব কৃষকের স্বার্থরক্ষা, বর্গাদার কৃষকের অধিকার কায়েম করা, সিলিংবহির্ভূত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন, ক্ষেতমজুরি বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের পথিকৃৎ তিনি। এই মানুষটি এ জন্যই জননেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন রক্তে-মজ্জায় প্রকৃত বামপন্থী এবং মানুষ হিসেবে অত্যন্ত নির্লোভ। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল লৌহকঠিন এক ধরণের দৃঢ়তা। তার দুই দশকের মুখ্যমন্ত্রিত্ব সারা পৃথিবীর কাছে একটি দৃষ্টান্ত। প্রশাসক হিসেবে তাঁর তুলনা ভারতবর্ষের ইতিহাসে খুব কমই রয়েছে। কৃষকের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অকৃত্রিম।
আমার ছেলেবেলায় আমাদের গঞ্জে ১৯৬৮ সালে দুর্ভিক্ষের বছর জ্যোতি বসু একটি জনসভা করেন, সেখানে মধ্যবিত্তের সঙ্গে সারা তল্লাটের কৃষকরা এসেছিলেন। তাঁদের সম্বোধন করে এই জননেতা প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি বাংলার গরিব মানুষের জন্য এক টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবেন। এই কথা তিনি বলেছেন যখন কালোবাজারে পাঁচ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি হচ্ছিল। গরিব মানুষ সারা ভারতে তখন ভাতের মুখ দেখত না। আমেরিকা গম পাঠিয়েছিল। তার আটা ৩৬ নয়া পয়সা কেজি দরে মুদিখানায় পাওয়া যেত। মাইলো, কুট্টি, বাজরার আটা খেয়ে দিন গুজরান করতে হতো মানুষকে। আশ্চর্যের বিষয়, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর এক টাকা দরে জ্যোতি বসু সাধারণ মানুষকে চাল দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘকাল চাল, আলু ইত্যাদির দাম পশ্চিমবঙ্গে বাড়েনি, যা বেড়েছে তাও খুব সামান্য। প্রায় দু’দশক জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখলেন জ্যোতি বসু এটাই বামফ্রন্টের সাফল্যের গোড়ার কথা।
জ্যোতি বসু জননেতা হওয়া সত্ত্বেও দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কখনও কোনো পদক্ষেপ নেননি। তার অসম্ভব জনপ্রিয়তা কখনও তাঁকে কমিউনিস্ট মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি। ভারতের মানুষ যখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রীরূপে দেখতে চাইছিল, ভারতের সব রাজনৈতিক দল জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, সেই অবস্থাতেও জ্যোতি বসুর কাছে দলের সিদ্ধান্ত ছিল শেষ কথা। দল তখন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার জন্য সম্মতি দেয়নি। ফলে জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলেন না। এই ঘটনায় জ্যোতি বসুর নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ তাঁর চরিত্রের নির্লোভ অভিব্যক্তি কতভাবেই না ঘটেছে। তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষ একজন জননায়ককে হারাল। বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষতি হলো।
samakal/bangladesh
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান